কুড়িগ্রামে ভিক্ষুকের টাকা আত্নসাত সমাজ সেবা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।।
কুড়িগ্রামে ভিক্ষুকের টাকা আত্নসাত এবং জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভাতা সুবিধাভোগীর তালিকা থেকে বাদ দেবার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা সমাজ সেবার সাবেক এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নিয়ম মোতাবেক হবার দাবী করেন সাবেক উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা।

সরেজমিনে দেখা যায়,কুড়িগ্রাম উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষা শ্যামপুর গ্রামের মৃত নগেন চন্দ্র পালের মেয়ে সবিতা রাণী। জায়গা জমি না থাকায় একজনের সুপারির বাগানে একটু সামান্য একটু জমিতে কােন রকমে ছাপ ঘর করে বসবাস করছেন একাই। সবিতা রাণীর জমি জমা সব ছিল। কিন্তু স্বামী শসি মোহন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সব শেষ। তার স্বামী মারা গেছে প্রায় দশ বছর। এরপর দুটি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজেই নি:স্ব জীবন কাটাচ্ছেন। ভিক্ষাবৃত্তি আর অন্যের বাড়িতে কাজ করে চলছে তার জীবন। একই অবস্থা প্রতিবেশি মৃত: মানিক চন্দ্র পালের স্ত্রী গোলাপী রাণীরও। কিডনি রোগী স্বামী আক্রান্ত এবং একমাত্র মেয়ে ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত মারা যায় বেশ কয়েক বছর আগে। যেটুকু জমি ছিল সেগুলো চিকিৎসার পিছনে বিক্রি করে এখন নি:স্ব। এখন এক শতক জমিতে দুটি টিনের ঘর করে কোন রকমে ভিক্ষাবৃত্তি করেই দিন কাটছে তারও।

একই ইউনিয়নের নয়াগ্রামের মৃত গহরের মেয়ে আশির্ধ্বো গোলেনুর বেওয়া বিধবা ভাতা পেতেন ২০০৮সাল থেকে। কিন্তু তাকে মৃত দেখিয়ে প্রায় আড়াই বছর আগে বিধবা ভাতা তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করেও নাম অর্ন্তভুক্ত করতে পারেননি। বাস্তবে এখনো তিনি জীবিত থাকলেও কাগজ-কলমে তিনি মৃত।

ওই ইউনিয়নের হাতিয়া ভবেশ গ্রামের বাসিন্দা বিধবা আনোয়ারা বেওয়া জীবিত হয়েও তিনি এখন মৃত উপজেলা সমাজসেবার বিধবা ভাতার তালিকায়। ফলে প্রায় দু’বছর ধরে তিনি ভাতা বঞ্চিত হয়ে আছেন। এই বিষয়ে অফিসে যোগাযোগ করেও কোন ফল পায়নি সুবিধাভোগীরা। অভিযোগ রয়েছে মোটা অংকের বিনিময়ে সাবেক উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এমন অনিয়ম করেছেন।

অনুসন্ধানে দেখাযায়,২০১৯-২০অর্থ বছরে উপজেলা সমাজসেবা ভিক্ষুক পুর্নবাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পে ১৮জন ভিক্ষুককে জনপ্রতি ১৪হাজার করে দু’লাখ ৫২হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এরমধ্যে সাহেবের আলগা ইউনিয়নে-৭জন,দলদলিয়া ইউনিয়নে-৪জন,হাতিয়া ইউনিয়নে-৩জন,ধামশ্রেণী ইউনিয়নে-৩জন এবং গুনাইগাছ ইউনিয়নে-১জন। এছাড়াও উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভাতা ভোগীর তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া হয়েছে।

তারা হলেন,হাতিয়া ইউনিয়নের সবিতা রাণী এবং গোলাপী রাণী,সোনারী পাড়ার ৮নং ওয়ার্ডের মৃত তমেজ উদ্দিনের ছেলে মজিবর রহমান। গুনাইগাছ ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি গ্রামের ৮নং ওয়ার্ডের হাসেন আলীর মেয়ে হাছেনা বেগম। ধামশ্রেণী ইউনিয়নের উত্তর বিজয়রাম গ্রামের ৯নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিমের ছেলে ছামছুল হুদা,ওই ওয়ার্ডের বিজয় তবকপুর গ্রামের বরকত আলীর মেয়ে বরিতন বেগম, ৮নং ওয়ার্ডের পশ্চিম দরিচর পাঁচপাড়া গ্রামের পনির উদ্দিনের ছেলে নুরুজ্জামান। সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সাহেবের আলগা গ্রামের মধু মোল্লার মেয়ে জামিরন নেছা, ৪নং ওয়ার্ডের সোনাভানের মেয়ে তারিপ জান,সোনা উল্ল্যা মেয়ে সাহেরা খাতুন, ৫নং ওয়ার্ডের উত্তর নামাজির চর ছাবেদ আলীর মেয়ে বাতাসী বেগম,জেহাত এর মেয়ে রমেচা খাতুন,নেছাব উদ্দিনের মেয়ে শাহেরা খাতুন,ওসমান গণির মেয়ে সুকুরজান বেগম। দলদলিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের উত্তর দলদলিয়া গ্রামের আশরাফ উদ্দিনের নুরজাহান বেগম,সাহেবের কুটি গ্রামের বাশারতের মেয়ে আছমা খাতুন,৫নং ওয়ার্ডের মিয়াজি পাড়ার আমির উদ্দিনের ছেলে হাজির উদ্দিন এবং কেতাব উদ্দিনের মেয়ে কাছুয়ানী বেগম।

ভিক্ষুক পুর্নবাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পের তালিকায় নাম থাকলেও টাকা কিংবা সহায়তা জোটেনি তাদের ভাগ্যে।

সবিতা রাণী বলেন,আমি উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে কোন ধরনের টাকা পয়সা পাইনি। তালিকা কে বা কারা নাম দিয়েছে আমি জানি না। ভিক্ষা করেই দিন কাটে আমার। টাকার খোঁজ কিভাবে পাই।

গোলাপী রাণী বলেন,বেশ কয়েক বছর আগে উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দেবার কথা বলে নয়ন নামে এক ছেলে এসে আমার ফোন নাম্বার ও ভোটার আইডি নিয়ে যায়। তার কিছু দিন পরে টাকা না দিয়ে একটি কম্বল দিয়ে গেছে। এছাড়া আমি কোন টাকা পাইনি।

প্রতিবেশি বিজয় বলেন,সবিতা ও গোলাপাী রাণী খুবই নিরীহ। তারা যদি কোথাও থেকে কোন অনুদান বা সাহায্য পায় আমরা জানতে পারি। কিন্তু উপজেলা সমাজসেবা থেকে ভিক্ষুক পুর্নবাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প কোন ধরনের আর্থিক সহায়তা পাননি বলে তিনি নিশ্চিত করেন।

বঞ্চিত বিধবা ভাতা ভোগী গোলেনুর বেওয়া বলেন, ২০০৮সালে জুলাই মাস থেকে আড়াই শ টাকা ভাতা পাওয়া শুরু করি। কিন্তু প্রায় আড়াই বছর থেকে সেই ভাতা আমার বন্ধ হয়ে আছে। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমাকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। এরপর অনেক টাকা-পয়সা খরচ আর দৌড়ঝাপ করেও ভাতা প্রাপ্ত হতে পারিনি।

অভাবের সংসারে ছেলেরা রিক্সা চলে খায়। জিনিস পত্রের যে দাম তাতে করে ছেলেদের সংসার চলে না। আমার এখন ওষুধ এবং টুকটাক খরচ কিভাবে চালায় তারা। এখন জীবিত হয়েও সমাজসেবা অফিসের কাগজে মারা গেছি।

আনোয়ারা বেওয়ার সন্তান সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমার মা জীবিত অথচ উপজেলা সমাজসেবা অফিসে ভাতার তালিকায় সে মৃত। বহু দৌঁড় ঝাপ করেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি। প্রায় দু’বছর পার হলো ভাতা বন্ধ হয়ে আছে। যে অফিসার এই কাজ গুলো করেছে সে তো বদলি হয়ে গেছে। সে নিশ্চয়ই কোন উৎকোচের মাধ্যমে জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে নাম পরিবর্তন করেছে?

হাতিয়া ইউনিয়নের হাতিয়া ভবেশ টারী পাড়ার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন,উপজেলা সেবা অফিস থেকে ভিক্ষুক তালিকায় ৮নং ওয়ার্ডের ভিক্ষুক মজিবর রহমানের নাম দেয়া হয়েছে তা ভুল। কেননা এই ওয়ার্ডের ৮জন মজিবর রহমানের সাথে তালিকায় থাকা পিতার নামের মিল নেই। এদের মধ্যে কেউ ভিক্ষুক নয়। সবাই চলার মতো সক্ষম।

সাবেক হাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এবিএম আবুল হোসেন বলেন,আমি চেয়ারম্যান থাকা কালিন ভিক্ষুক পুর্নবাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প সম্পর্কে জানতাম না। আমার সময় কোন ভিক্ষুক সেই টাকা পেয়েছে এমন কোন তথ্য আমার কাছে নেই। তৎকালিন সমাজসেবা অফিসার বলতে পারবেন কাকে কিভাবে এই টাকা বিতরণ করেছেন।

উপজেলার ভিক্ষুক পুণ:বাসন করার সাবেক কমিটি সভাপতি মহিউল ইসলাম মুকুল হাজি বলেন,আমার উপজেলায় কোন ভিক্ষুককে সমাজসেবা থেকে কোন অর্থ বা অনুদান দেয়া হয়নি।

এই বিষয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া এবং তালিকাভুক্ত ভিক্ষুকরা টাকা না পাওয়ার বিষয়টি তিনিও অবগত আছেন বলে জানান। সঠিক তদন্ত করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির পাশাপাশি বাদ দেয়া ভাতা ভোগীদের পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভিক্ষুকদের টাকা ফিরে দেবার দাবী জানান তিনি।

উলিপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন,ভিক্ষুকদের টাকা না পাওয়া এবং ভাতা ভোগী অনেক জীবিত ব্যক্তিদের মৃত দেখিয়ে নাম বাদ দেয়ার অভিযোগ মৌখিক ভাবে পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন,এই বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযাগ করেনি। লিখিত অভিযোগ দিলে আমার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করবো।

তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, সময় মতো অনলাইনে নিবন্ধন করতে না পারায় অনেকের তালিকা থেকে নাম বাদ গিয়ে পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়াও ভিক্ষুকের টাকা না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন,তৎকালিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিদের মিটিং করে তালিকা করার পরেই তিনি টাকা বিতরণের আগেই অন্যত্র বদলি হয়ে যান।

অনুসন্ধানে আরও দেখাযায়, সাবেক উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মশিউর রহমান ২০১৯সালের ১জুলাই উলিপুর উপজেলায় প্রথম যোগদান করেন। পরে তিনি ২০২১সালে মাদকসহ রংপুর র‌্যাব-১৩ এর হাতে আটক হলে তাকে একই বছর ১৫ডিসেম্বর বরখাস্ত হন। এরপর ২০২২সালের ২১জুন তিনি স্ব-পদে আবারও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি ওই বছর ১৪ নভেম্বর বদলি হয়ে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলায় চলে যান।

এফআর/অননিউজ

আরো দেখুনঃ